মানুষের জন্য মানুষ/পরিবার পরিজনের সন্ধান পাওয়া জন্য একটি শেয়ার করুন

ফেসবুক থেকে পাওয়া:

আজকে বিকেলে একাডেমি থেকে আসার সময় হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে কী দেখছে।
উঁকি দিয়ে দেখি একজন লোক শুয়ে আছে। চোখে মুখে মাছি ভরে গেছে। শ্বাস যাচ্ছে আর আসছে। বোঝা যাচ্ছে জীবনের অন্তিম সময় কাছাকাছি। দাঁড়ানো মানুষগুলো তার অবস্থা দেখে আফসোস করছে। আবার কেউ কেউ দেখে চলে যাচ্ছে। লোকটা সম্ভবত পাগল। তার শরীর থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে।
আমিও দেখে চলে যাচ্ছিলাম। দুপুরে খাওয়া হয়নি আমার। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। তাই বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। তবে কয়েক কদম গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। মানে দাঁড়াতে বাধ্য হলাম। মনে হলো এভাবে যদি লোকটাকে ফেলে যাই, আর রাস্তায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায় তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। ফিরে এলাম। পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম তাকে। কিন্তু খেয়েছে কিনা বোঝা গেলো না।
দাঁড়ানো কয়েকজনকে বললাম এ লোকটাকে হাসপাতালে নেয়া দরকার। হয়তো বেঁচে যেতে পারে। দুজন বললেন, কে নেবে ভাই? আমরা ড্রাইভার। এখানে ভাড়া নিয়ে এসেছি। আরেকজনও ব্যক্তিগত ব্যস্ততা দেখালেন। স্পষ্ট মনে হলো লোকটার মাছি ভর্তি, নোংরা শরীর দেখে কেউ সাহস করতে পারছে না। আমি বললাম, আমাদের সামনে যেহেতু লোকটা এই অবস্থায় পড়েছে, আমাদেরই দায়িত্ব তার জন্য কিছু করা। এখন আমরাই তার আত্মীয় স্বজন। আমি পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে বললাম, এই আমি দিলাম। আপনারাও তৌফিকমত টাকা দেন। দেখি ভ্যান গাড়ি পাওয়া যায় কী না। সবাই ১০,২০, ৫০ টাকা দিলেন। দেখতে দেখতে প্রায় ৬০০ টাকা হয়ে গেলো।

এরমধ্যে এক বৃদ্ধ মহিলা এলেন। বললেন, বাবা কিছু মনে করবেন না, আমার কাছে মাত্র ৩ টাকা আছে, তাই দিলাম। এই বলে তিনি একটা দুই টাকার নোট ও একটা একটাকার কয়েন দিলেন। এখন ভ্যান কোথায় পাই, বা নেয়ার জন্য মানুষ কোথায় পাই! ড্রাইভার দুজন বললেন, চলেন শাহজালাল দরগায় গিয়ে দেখি মানুষ পাই কিনা। দরগায় গিয়ে কয়েকজনকে বললাম, টাকা দেয়া হবে তাও বললাম। কিন্তু রোগীর অবস্থা কথা শোনে কেউ রাজি হয় না। পরে দরগার খাদিম সাহেবের কাছে গেলে দুজন মানুষ দিয়ে দেন। ওরা এসে রোগীর অবস্থা দেখে ভয় পাচ্ছে। যদি লোকটা মারা যায় তাহলে পুলিশি ঝামেলা হতে পারে। আমি সাহস দিয়ে বললাম এরকম ব্যাপারে পুলিশি ঝামেলা হওয়ার কথা না। ঝামেলা হলে আমার উপর দিয়ে যাবে। আপনারা ধরেন। সাথে সাথে ছুটে গেলাম সিলেট পুলিশ লাইনে।

আমার পরিচয় দিয়ে পাগলের অবস্থা বলতেই তারা আমাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, আমরা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে জানিয়ে দিচ্ছি। পুলিশ আপনাকে সাহায্য করবে।
কিছুক্ষণ পরেই একটা সিএনজিতে করে একজন এএসআই এর নেতৃত্বে তিনজন পুলিশ এলেন। এরমধ্যে আমার বন্ধু, বিজিবি স্কুলের শিক্ষক মুশতাককে কল দিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেও উপস্থিত হলো। পুলিশ সদস্যরাও কিছু টাকা দিলেন। সবাই ধরাধরি করে তাকে ভ্যানে তুললাম। পুলিশ সদস্যরাও হাত লাগালেন রোগীকে ভ্যানে তুলতে। তারা ওসমানী মেডিকেল কলেজের পুলিশ বক্সেও কল দিলেন।

তিনজনই আমাদের সাথে ওসমানীতে গেলেন। পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন আমাদের। সেখানেও রোগীকে ভর্তিসহ সব কাজে সহযোগিতা করলেন। প্রায় দুঘন্টা সময় দিলেন তারা। খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে। এরমধ্যে আরেকটা ব্যাপার খুব মনে ধরেছে। যে ভ্যানচালক রোগীকে বহণ করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন তিনি বিনিময়ে একটি টাকাও নিলেন না। অনেক জোড়াজুড়ি করেও টাকা দেয়া সম্ভব হয়নি।

ভর্তির কাগজে রোগীর নাম ঠিকানা অংশে লেখা হলো অজানা 😥। পাশে আমার নাম, মোবাইল নাম্বার।
এই পুরো সময়টা পুলিশের এএসআই আব্দুল মালেক, পুলিশ সদস্য মোশাহিদ হাসান, ইমরান ভাইয়ের ব্যবহার ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছি। তাদের ব্যবহারে সত্যিই মনে হয়েছে পুলিশ জনগণের বন্ধু।

এরকম পুলিশই জাতির প্রয়োজন। কয়েকদিন আগে অনলাইনে ভাইরাল হওয়া পুলিশের মানবিক এক সদস্য শওকত এর কথাও তাদের বললাম। বললাম, আপনাদের মত মানুষ যত বাড়বে, ততই আপনাদের ডিপার্টমেন্ট এর সুনাম বৃদ্ধি পাবে।

রোগীকে ওয়ার্ডে নেয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার দেখতে এলেন। মেয়ে ডাক্তার। তিনি হাত দিয়ে পালস্ দেখলেন। খালি হাত দিয়ে চোখ মুখ ধরে পরীক্ষা করলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম, দুর্গন্ধ ভরা, নোংরা কাপড় পরা পাগল ধরনের রোগীকে দেখতে ডাক্তার একটুও বিরক্ত বা বিব্রত হননি। তার চেহারায়ও ন্যুনতম তাচ্ছিল্যভাব ছিল না। বিভিন্ন টেস্ট দেয়া শুরু হল। সাথে সেলাইন। কিছুক্ষণ পর আমরা ও পুলিশ সদস্যরা নীচে নেমে এলাম। তাদের কাছ থেকে মোবাইল নাম্বার বিনিময় করে বিদায় নিলাম। মধুশহীদের এক মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়লাম আমি আর মুশতাক। নামাজ শেষে মুশতাক আমাকে বললো- সাইয়িদ, নামাজে আমি কি দোয়া করেছি জানো? বললাম কী? সে বললো – ‘দোয়া করেছি লোকটা যেন ভালো হয়ে যায়। তার পরিবারের কাছে ফিরতে পারে। না জানি কার মায়ের বুকের ধন!’

আমার মনে একটা ক্ষীণ আশার আলো জ্বলছে। যেহেতু হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানো গেছে, অন্তত জীবনের এই অন্তিম সময়টা রাস্তায় পড়ে থাকতে হলো না। প্রাণটা শান্তিতে দেহ ছাড়া হবে। আর আল্লাহ চাহেন তো লোকটা বেঁচেও যেতে পারে। ভাবতে ভাবতে আমরা বাসার দিকে রওয়ানা দিতেই অজানা একটা নাম্বার থেকে কল এলো। মেয়ে কণ্ঠ। হাসপাতালের নার্স। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি সাইয়িদ বলছেন? জবাব দিলাম, জ্বি।
ওপার থেকে জবাব এলো, আপনার অজ্ঞাতনামা রোগী আর নেই।
আমি আর মুশতাক আবার ছুটলাম হাসপাতালে। গিয়ে দেখি নিথর হয়ে পড়ে আছে তার দেহ। অজ্ঞাতনামা মানুষটার পরিচয় এখন শুধুই লাশ।

আপনারা দেখুন তো কেউ চেনেন কিনা। লাশটা মর্গে চলে যাচ্ছে আজ রাতেই। লোকটার বয়স আনুমানিক ৪০ হবে।

অনুগ্রহ করে লেখাটি শেয়ার করবেন।
দোয়া করি, তার পরিবার পরিজন অন্তত লাশের সন্ধান পাক। ফেইসবুকের এ যুগে পরিবার পরিজনের সন্ধান পাওয়া খুবই সম্ভব।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.