শিলাস্তির তথ্যে মাংস খণ্ডের ক্লু পায় ডিবি

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যায় ঢাকা ও কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছে চারজন। ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে একজন শিলাস্তি রহমান। এমপি আনারকে হত্যার সময় কলকাতা নিউটাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের ওই ফ্ল্যাটে ছিল শিলাস্তি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তদন্ত কর্মকর্তারা এমপি আনারের খণ্ডিত মরদেহ কোথায় ফেলা হয়েছে, সে বিষয়ে প্রথম ক্লু পান। শিলাস্তি তদন্ত কর্মকর্তাদের জানিয়েছিল, সে ওই ফ্ল্যাটের একটি টয়লেটের ভেতরে ঘন ঘন কমোড ফ্ল্যাশ করার শব্দ শুনেছেন। তার দেওয়া এই তথ্যে ফ্ল্যাটের সুয়ারেজ লাইন ধরে সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে উদ্ধার করা হয় প্রায় পাঁচ কেজি মাংস, যেগুলো টুকরো টুকরো করা। এ ছাড়া কিছু চুল, চামড়া ও হাড়ও পাওয়া গেছে। উদ্ধার হওয়া অংশগুলো নিহত এমপি আনারের কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য ল্যাবে পাঠিয়েছে কলকাতা সিআইডি।

এদিকে আজ শনিবার সকালে এমপি আনার হত্যার ঘটনা তদন্তে নেপালে যাচ্ছে ডিএমপি ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের গোয়েন্দা দল।

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ঢাকায় গ্রেপ্তার তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে কোথায় মরদেহ ফেলা হয়েছে, তা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল। পৃথক জিজ্ঞাসাবাদের সময় শিলাস্তি জানিয়েছিল, এমপি আনারকে হত্যার পর কেটে টুকরো টুকরো করার সময় তিনি ফ্ল্যাটের ওপরের অংশে ছিল। নিচে টয়লেট থেকে ঘন ঘন ফ্ল্যাশ করার শব্দ পেয়েছে। তার এ তথ্যের সূত্র ধরে বাকি দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন, তারা টয়লেটে বসে মরদেহ টুকরো করা, হাড় থেকে মাংস আলাদা করার সময় কিছু মাংসের টুকরো কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ করেছে। পরবর্তী সময়ে তদন্তে কাজে কলকাতায় যাওয়ার পর ডিবি কর্মকর্তারা একই বিষয়ে কলকাতায় গ্রেপ্তার জিহাদ হাওলাদারের কাছেও জানতে চেয়েছেন। সেও ফ্ল্যাশ করার বিষয়টি স্বীকার করেছে।

কমোডে ফ্ল্যাশ করে দেওয়া মাংসের টুকরোগুলো সেপটিক ট্যাঙ্কে পাওয়া যেতে পারে, সেই ধারণা থেকে কলকাতা সিআইডিকে তা চেক করার অনুরোধ জানান ডিবির কর্মকর্তারা। এর পরই ২৮ মে সঞ্জিভা গার্ডেন্সের সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে মাংসের টুকরো, চুল, চামড়া ও হাড় উদ্ধার করা হয়। ফরেনসিক টেস্ট ও ডিএনএ ম্যাচ করার মাধ্যমে জানা যাবে, উদ্ধার হওয়া খণ্ডিত অংশগুলো নিহত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের কি না।

এদিকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া ও শিলাস্তি রহমানকে ফের ৫ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে ডিবির ওয়ারী বিভাগ। গত ২৩ মে তাদের গ্রেপ্তারের পর ৮ দিনের রিমান্ড পায় ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গতকাল শুক্রবার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি ওয়ারী বিভাগের সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান ৮ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। আদালত প্রত্যেকের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আনারকে রিসিভ করার দায়িত্ব ছিল শিলাস্তির

১২ মে ঝিনাইদহ থেকে কলকাতা যাওয়ার পর বন্ধু গোপালের বাসায় ছিলেন এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার। পরদিন চিকিৎসার কথা বলে গোপালের বাসা থেকে বের হন তিনি। চিকিৎসার কথা বলে বাসা থেকে বের হলেও এমপি আনার যান নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটে। যেখানে তাকে ওই দিনই (১৩ মে) হত্যা করা হয়। বাল্যবন্ধু শাহীনের সঙ্গে ব্যবসার কথা বলতে ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন আনার। তাকে সঙ্গে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে পৌঁছায় গ্রেপ্তার শিমুল ভূঁইয়া ও পলাতক ফয়সাল। ফ্ল্যাটের ভেতরে থেকে সংসদ সদস্য আনারকে রিসিভ করার দায়িত্ব ছিল শাহীনের বান্ধবী শিলাস্তি রহমানের।

মামলাটি তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, শিলাস্তি রহমান এমপি আনারকে হত্যার সময় ওই ফ্ল্যাটে ছিল। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, শিলাস্তির দায়িত্ব ছিল এমপি আনারকে রিসিভ করা। ওই ফ্ল্যাটে এমপি আনারের যাওয়ার নেপথ্যে ব্যবসার পাশাপাশি শিলাস্তিও একটি কারণ হিসেবে ছিল।

গ্রেপ্তার শিমুল ভূঁইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে এই কর্মকর্তা জানান, এমপি আনারকে হত্যা ও হাড়-মাংস আলাদা করার কাজে সরাসরি যুক্ত ছিল শিমুল, ফয়সাল, মোস্তাফিজ ও জিহাদ। আর হাড় ও শরীরের অন্যান্য অংশ দূরে ফেলার কাজটি করেছে পলাতক সিয়ামসহ অজ্ঞাতপরিচয় একাধিক ব্যক্তি।

সিয়ামের বর্তমান অবস্থান নেপালে বলে জানিয়েছেন ডিবির এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এরই মধ্যে সিয়াম নেপালে গ্রেপ্তার হয়েছে। তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ডিবির একটি দল নেপাল যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্চে।

এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে

ডিবি ও কলকাতা সিআইডির তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে আক্তারুজ্জামান শাহীন। তা বাস্তবায়ন করে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া, শিলাস্তি রহমান, জিহাদ হাওলাদারসহ অন্যরা। কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেন্সের ফ্ল্যাটে আনারকে হত্যার আগে গত জানুয়ারি ও মার্চ মাসে দুবার হত্যার পরিকল্পনা করেও তারা ব্যর্থ হয়। পরে ঠিক করা হয় কলকাতা নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হবে আনারকে। সে অনুযায়ী, এমপি আনারের গতিবিধি নজরে রাখছিল শাহীনের লোকজন। ব্যবসায়িক বৈঠকের কথা বলে আনারকে শাহীনই কলকাতায় ডেকে নেয়। বৈঠকের স্থান নির্ধারণ করা হয় সঞ্জিভা গার্ডেন্সের ওই ফ্ল্যাটে। শাহীন ১১ মাসের জন্য এই ফ্ল্যাটটি ভাড়া করে। এমপি আনার কলকাতায় পৌঁছার আগেই গত ৩০ এপ্রিল শিমুল ভূঁইয়া, শিলাস্তি রহমানকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন শাহীন। হত্যার সমস্ত ছক চূড়ান্ত করে এমপি আনার কলকাতা পৌঁছার দুদিন আগে ১০ মে শাহীন দেশে ফিরে আসে, যা আনার জানতেন না।

গত ১৩ মে এমপি আনারকে হত্যা করা হলেও তার মোবাইল নম্বরটি সময়ে সময়ে চালু করা হয়েছিল। তার নম্বর থেকে পরিবার ও গোপালকে বিভিন্ন সময় মেসেজও দেওয়া হয়েছে। এমপির মোবাইল ফোনটি নিয়ে আসামিরা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছে, যাতে তদন্তকারীরা বিভ্রান্ত হয়। আনারের কোনো সন্ধান না পাওয়ার বিষয়টি গোপালকে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানোর পর ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর পুলিশ স্টেশনে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন গোপাল। এদিকে ডিএমপি ডিবিকেও নিখোঁজের বিষয়টি জানানো হয়। তারা তদন্ত করে ২৩ মে ঢাকা থেকে শিমুল, তানভীর ও শিলাস্তিকে গ্রেপ্তার করে ডিবি ওয়ারী বিভাগ। এর আগে ২২ মে এমপি আনার পরিকল্পিত হত্যার শিকার হয়েছেন বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

এদিকে বৃহস্পতিবার কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরেছে ডিবির প্রতিনিধিদল। ফিরে ডিবিপ্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, ‘মামলাটাকে আমরা একটা কনক্লুসিভ পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা সবাই বাংলাদেশের। বাকি যারা আছে, তাদের আমরা দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের মুখোমুখি করব।’

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.