সেনাবাহিনীর তাৎক্ষণিক তৎপরতায় রক্ষা পেল ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা

সাইফুল ইসলাম: বান্দরবান জেলা প্রতিনিধি
বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় ১৭ ঘণ্টার ব্যবধানে দুই ব্যাংকের তিন শাখায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। দুটি শাখা সোনালী ব্যাংকের, আরেকটি কৃষি ব্যাংকের। রুমায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি হয় গত মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) রাতে। আর থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি হয় বুধবার (৩ এপ্রিল) দুপুরে। তবে এসব ঘটনায় সেনাবাহিনীর তাৎক্ষণিক তৎপরতায় ব্যাংকগুলোর ভল্টে রক্ষিত কোটি কোটি টাকা সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) রাত ৯টায় বান্দরবানের রুমা উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংকে হামলা চালিয়ে ম্যানেজারকে জিম্মি করে টাকা ও অস্ত্র লুট করে সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা। এসময় ঐ ব্যাংকের ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে তারা।
একই সময় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসারদের নিকট থেকে অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) এর অর্ধ শতাধিক সন্ত্রাসী রাত ৯টার দিকে এসে বাজারের মসজিদ ও ব্যাংক ঘেরাও করে সবাইকে জিম্মি করে রাখে।
এসময় তারা ডিউটি পুলিশের ১০টি অস্ত্র ও আনসার বাহিনীর ৪টি গুলিসহ অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ঈদুল ফিতর ও বৈসাবি উপলক্ষে বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাসের টাকা হিসেব করছিলেন ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। তারাবিহের নামাজের সময় হলে ম্যানেজার ব্যাংকের বিপরীতে থাকা মসজিদে নামাজ পড়তে যান। এসময় ৭০-৮০ জনের মতো একটি উপজাতীয় সশস্ত্র দল ব্যাংক ঘেরাও করে পুলিশ ও আনসার সদস্যসহ ব্যাংকের সকল কর্মচারীদের জিম্মি করে। পুলিশ ও আনসারদের নিকট থেকে সকল অস্ত্র ও গুলি নিয়ে নেয়।
এসময় তারা ম্যানেজারকে খোঁজ করলে কর্মচারীরা জানান, ম্যানেজার তারাবিহের নামাজ পড়তে গেছেন। এ কথা শুনে সন্ত্রাসীরা মসজিদ ঘেরাও করে সকল মুসল্লিকে জিম্মি করে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় এবং ম্যানেজারের খোঁজ করে। মুসল্লিরা প্রাণভয়ে ম্যানেজারকে দেখিয়ে দিলে তারা ম্যানেজারকে নিয়ে এসে ব্যাংকের ভল্ট ভাঙ্গার চেষ্টা করে।
কিন্তু এরমধ্যেই ঘটনার খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে সন্ত্রাসীরা ভল্ট ভাঙ্গার চিন্তা বাদ দিয়ে ম্যানেজারকে জিম্মি করে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।
অপরদিকে বুধবার (৩ এপ্রিল) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে থানচি বাজারে ডাকাতরা হানা দেয়। স্থানীয়রা জানান, তিনটি পিকআপ নিয়ে প্রায় ৩০ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাজারে আসে। গাড়িগুলো সাঙ্গু ব্রিজের পাশে থামিয়ে তারা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালায়। আশপাশে থাকা মানুষজনের সেলফোনও ছিনিয়ে নেয়। এরপর ডাকাতরা তিনটি দলে ভাগ হয়ে যায়। একটি দল সাঙ্গু নদীর পাড়ে পাহারা দিতে থাকে। বাকি দুটি দলের একটি যায় সোনালী ব্যাংকে, আরেক দল ঢুকে পড়ে কৃষি ব্যাংকে। তারা ব্যাংকে প্রবেশের পর বাইরে থাকা লোকজন কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শুনতে পায়। ব্যাংকের সবাইকে জিম্মি করে ক্যাশে থাকা টাকা লুট করে। তবে কৃষি ব্যাংকের কোনো ভল্ট না থাকায় তারা সোনালী ব্যাংকে নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। এসময় ব্যাংকের ম্যানেজার ফয়সাল হুদাকে জিম্মি করে ভল্ট ভাঙার চেষ্টা চালানো হয়।
তবে তাৎক্ষণিক সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনার বিষয় জানতে পেরে তাৎক্ষণিক অভিযান শুরু করে। বিষয়টি টের পেয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ভল্ট ও শাখা ম্যানেজারকে রেখেই পালিয়ে যায়। কৃষি ব্যাংক থেকে ২ লাখ ৪২ হাজার টাকা এবং সোনালী ব্যাংক থেকে আনুমানিক ১৫ লাখ টাকা নিয়ে গেছে ডাকাতরা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়, দুটি ঘটনাতেই সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিক তৎপর না হলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীর রুমা এবং থানচি উপজেলার সোনালী ব্যাংকের ভল্ট ভেঙ্গে কয়েক কোটি টাকা লুট করে নিয়ে যেত। অন্যদিকে ম্যানেজারসহ ব্যাংকের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু সেটি আর শেষ পর্যন্ত তারা করতে পারেনি। এসব ঘটনার পর সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীদের নির্মূলে যৌথবাহিনীর জোরদার অপারেশন অব্যাহত আছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও সেনাবাহিনীর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে অসংখ্য উপজাতি মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা পেয়েছে।
এদিকে ঘটনা ঘটার পরপরই সেনাবাহিনী সমগ্র এলাকা জুড়ে কর্ডন করে তল্লাশি শুরু করার কারণে সন্ত্রাসীরা অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজারকে নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে যেতে পারেনি। এমনকি খুব বেশি দুরেও যেতে পারেনি। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ড্রোন দিয়ে পুরো এলাকা সার্ভাল্যান্স শুরু করলে সন্ত্রাসীরা বাধ্য হয় ব্যাংক ম্যানেজারকে মুক্তি দিতে।
এমনকি ৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাতে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা পুণরায় থানচি বাজার আক্রমণ করতে এগিয়ে এলে সেনবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুললে সন্ত্রাসীরা খুব বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে দ্রুত পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে থানচি বাজার ও স্থানীয় জনগণ। সেনাবাহিনীর এই সাহসী ও তাৎক্ষণিক ভূমিকার কারণে স্থানীয়দের সন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা যায়।

 

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.