সিলেটের পাথর কোয়ারী বন্ধ থাকায় ১০লক্ষাধিক শ্রমিকের ভাগ্য অনিশ্চয়তার আধাঁরে

মো.দুলাল হোসেন রাজু,গোয়াইনঘাট (সিলেট) প্রতিনিধি,

অভাবের আগুন জ¦লছে সিলেটের জাফলং-জৈন্তার শ্রীপুরের পাথর রাজ্য ঘিরে। পাথর সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের জীবন এখন দুর্বিষহ। দীর্ঘ ৫ বছর ধরে শ্রমিকদের পরিবারে বিরাজ করছে হাহাকার। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে পাথর কোয়ারী সংশ্লিষ্ট লক্ষাধিক পাথর শ্রমিকের। পাহাড়ী ঢলে ভেসে আসা বালু-পাথরই স্থানীয় শ্রমিকদের ভাগ্যের উন্নয়ন ও বেঁচে থাকার এক মাত্র অবলম্বন। যুগ-যুগ ধরে এভাবেই চলছিল সীমান্ত ঘেষা পাথর সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন। কিন্তু সমৃদ্ধ অতীত এখন অনিশ্চয়তার আঁধারে ডা’কা পরে গেছে।

 

গত ৫ বছর ধরে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে সিলেটের ভোলাগঞ্জ,জাফলং,লোভাছড়া ও বিছনাকান্দিসহ অন্যান্য পাথর কোয়ারী।জাফলং পাথর কোয়ারীতে কাজ করেন শেওলারটুক গ্রামের বাসিন্দা পাথর শ্রমিক আব্দুল বাছেদ বলেন, হাইকোর্টে আদেশ ছিল সনাতন পদ্ধতি শ্রমিকের হাতে পাথর উত্তোলনের। কিন্তু জেলা প্রশাসক আদেশ থাকার পরও পাথর উত্তোলন করতে দেন না। তিনি পরিবেশের কথা বলেন। মানুষ যদি না খাইয়া মরে এটা কি পরিবেশ? আব্দুল বাছেদ প্রায় ২০ বছর থেকে পাথর শ্রমিকের কাজ করছেন। এর আগে পূর্ব পুরুষরা এই কাজই করেছেন।

 

এখন পাথর তুলতে না দিলে শ্রমিকদের ভাত দিতে হবে। শান্তি নগর, নয়াবস্তি কান্দুবস্তি নয়াগাঙ্গের পার ,বাউর ভাগ, মুমিন পুর, নাইন্দার হাওড়, তিতিকুল্লীর হাওড়, বুধিগাও হাওড়, রাজবাড়ী কান্দি, সানকী ভাঙ্গা,আসাম পাড়া, ছৈলাখেল, লাখের পাড়,নলজুরী,কালি নগর এলাকার একাধিক শ্রমিকরা জানায়,মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি এমনকি আশ্রয়স্থল তৈরী করে দিয়েছে সরকার। আমরা শ্রমিকরা তো বাড়ি ঘর চাই না,আমরা কাজ চাই,কাজ করে সংসার চালাতে চাই,তাতে পরিবেশবাদীদের এতো মাথা ব্যাথা কেন?। আমরা পাথর উত্তোলন করে বেচা-কেনা করে আমাদের সংসার চলে। এছাড়া আমাদের বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান নেই,পাথর উত্তোলন করাই আমাদের উপার্জনের একমাত্র পথ।এই পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের শ্রমিকদের ভাগ্য অনিশ্চিয়তার মধ্যে রয়েছি। জাফলং ও শ্রীপুর পাথর কোয়ারীর একাধিক সূত্র জানায়,শতকরা ৮০ থকে ৯০ ভাগ শ্রমিকের পরিবার পাথর কেন্দ্রীক উপার্জন নির্ভর।

 

সংশ্লিষ্ট পাথর কোয়ারীগুলোতে হবিগঞ্জ,সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন পাথর শ্রমিক হিসেবে জাফলং ও শ্রীপুর পাথর কোয়ারীতে শ্রমিকের কাজ করে জীবন জীবিকানির্বাহ করতেন। ইসিএভুক্ত এলাকার বাইরে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের কথা থাকলেও কোন প্রকার পাথর উত্তোলন করতে দিচ্ছেনা প্রশাসনর্। পূর্ব ঘোষিত নোটিশ ছাড়াই প্রশাসন অভিযান চালিয়ে পাথর উত্তোলনের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে।পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় অনাহারে অর্ধাহারে জীবন যাপন করছে। সমিতির কিস্থির টাকা নেই, চিকিৎসা খরচ নেই,ঘরে বাজার নেই, সন্তাানের স্কুলের খরচ দিতে পারছেনা শ্রমিকরা।অবর্ণনীয় দুর্ভোগ এখন এই এলাকার দরিদ্র পাথর শ্রমিকদের।সরেজমিন জাফলং ও শ্রীপুর পাথর কোয়ারী পরিদর্শনে দেখা গেছে,পাহাড়ী ঢলে ভেসে আসা পাথর জাফলং ও শ্রীপুর পাথর কোয়ারীতে হাজার- হাজার কোটি টাকার পাথরের স্তুপ পড়ে রয়েছে।অথচ তা এখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পাহাড়ী ঢলে ভেসে আসা এসব পাথরের স্তুপ নদী থেকে সরানো না হলে পরিবেশ সংরক্ষণের বিপ্ররীতে পরিবেশ
আস্কা রয়েছে বলে মন্তব্য সচেতন মহলের।

 

 

অভাবের জ্বালা মেটাতে কেউ-কেউ পান-সুপারীর বাগান,গাছপালা কর্তন,করে ঘর-বাড়ির মাঠি খুঁড়ে পাথর খুঁজতে ব্যস্ত রয়েছে।কারণ এই পাথরই তাদের অতীত,বর্তমান এবং ভবিষ্যত। বৃহত্তর সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নের্তৃবৃন্ধরা বলছেন, বিগত সময়ে পাথর উত্তোলনে বোমা মেশিনের ব্যবহার করেছিল একটি শক্তিশালী পাথর খেকো চক্র। সাধারণ শ্রমিকের কোন ভূমিকা নেই এতে। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা বলে বন্ধ করে দেয়া হলো পাথর উত্তোলন। স্থানীয় পাথর শ্রমিকরা উচ্চ আদালত থেকে সনাতনী পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের নির্দেশনা পেল। কিন্তু তা কার্যকর বা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের কোন উদ্যোগ নেই। যে নির্দেশনায় পাথর কোয়ারী সার্বিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হলো, একইভাবে পাথর উত্তোলনের নির্দেশনা কেন কার্যকর করা হয় না তা রহস্যজনক। তারা আরো বলেন, পরিবেশে বিপর্যয়ের কথা বলে চরম মানবিক বিপর্যয় সংশ্লিষ্ঠ এলাকার মানুষকে গ্রাস করছে। নেই বিকল্প কোন কর্মসংস্থান।

 

 

পাথর উত্তোলন পরিবহন ও বিপননের সুষ্ঠ ব্যবহারের নেই কোন উদ্যোগ।সম্প্রতি জাফলং পাথর কোয়ারী সংশ্লিষ্ট নদীতে কোন শ্রমিক কে নামতে না দেওয়ার প্রতিবাদে,গত ১৮ফ্রেব্রয়ারী শনিবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত মামার বাজার পয়েন্টস্থ-সিলেট তামাবিল মহা সড়ক অবরোধ করে রাখে উত্তেজিত শ্রমিকরা। এসময় সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ থাকে। যান চলচল বন্ধ থাকায় চরম দূর্ভোগে পড়ে জনসাধারন।এ সময় প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ সরজমিনে উপস্থিত হয়ে শ্রমিকদের কে বলেন, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পাথর উত্তলোনে আমার সুপারিস আছে। এ ব্যাপারে পাথর উত্তলোন বন্ধ করার আমার কোন একতিয়ার নেই।

 

 

এটি খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে রয়েছে।আমি এ ব্যাপারে সিলেট জেলা প্রসাশকের সাথে কথা বলবো।মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর সড়ক অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয় শ্রমিকরা। পরে যান চলাচল স্বভাবিক হয়। মন্ত্রী আরো বলেন,
পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করেই পাথর উত্তোলনের ব্যবস্থা করা জরুরি, আমি তো শ্রমিকদের পক্ষেই কথা বলছি। বিষয়টি
খনিজ সম্পদ ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের ব্যাপার। তবে খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়,স্থানীয় জনগোষ্ঠির কথা বিবেচনা করে শ্রমিকদের বাস্তবিক সমস্যা মাথায় রেখেই সমাধান করা অতি জরুরী।

 

 

 

উল্লেখ্য,পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিলেটের জাফলং, জৈন্তাপুরের -শ্রীপুর, কোম্পানীগঞ্জের- ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, বিছানাকান্দি ও লোভাছড়ার  কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর আগে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র দায়ের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোতে সব ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন উচ্চ আদালত। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী, খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদ সচিব ও সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ সব পর্যায়ের নীতি নির্ধারকদের কাছে একাধিকবার স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। যদিও পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে পরিবেশকর্মীরা পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে পরিবেশ আন্দোলন সংশ্লিষ্টদের অভিমত, পাথর উত্তোলনের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের যে কথা বলা হচ্ছে তার চেয়ে বড় ধরনের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখায়। কারণ প্রতিবছর পাহাড়ী ঢলে ভেসে আসা বালু ও পাথরের স্তুপ জমতে-জমতে ভরে গেছে নদীর তলদেশেসহ নদীর উপরিভাগ।এতে বন্ধ হচ্ছে নদীতে নৌ চলাচল,পাহাড়ী ঢলে ভেসে আসা বালু-পাথর নদীতে জমার কারণে নদীর উৎসপথ এখন পুরোপুরি স্থবির।

 

 

এব্যাপারে গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো.ফারুক আহমদ বলেন,পরিবেশ রক্ষা করে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে
পাথর তোলার অনুমতি দিলে তো পরিবেশের কোন ক্ষতি হওয়ার কথা না।এখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের রুটি-রুজির ব্যাপার।মানবিক বিবেচনায় হলেও পাথর কোয়ারী খোলে দিয়ে শ্রমিকদের বাচাতে হবে।এবিষয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী
অফিসার তাহমিলুর রহমান বলেন, আইনী জটিলতার কারণে কেবল ম্যানুয়াল পদ্ধতিই নয়? কোন পদ্ধতিয়ে নদী থেকে বালু
কিংবা পাথর উত্তোলন করা যাবে না। গোয়াইনঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ কেএম নজরুল ইসলাম বলেন,অবৈধ ভাবে নদী
থেকে পাথর উত্তোলন করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট পাথর কোয়ারী এলাকায় আমাদের টহল
অব্যহত রয়েছে।এ কারণে জাফলংয়ের পিয়াইন নদী ও শ্রীপুরের রাংপানি নদীর গতিপথ পাল্টে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নদীর এমন অবস্থা রহস্যজনক ভাবে দেখছেনা না পরিবেশ আন্দোলনকারীরা। শ্রমিকদের অভিযোগ, পরিবেশ বান্ধব
পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পাথর উত্তোলনের পদক্ষেপ না নিয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের দোহাই দিয়ে সিলেটের পাথর কোয়ারী
গুলো বন্ধ রাখতে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির হীন স্বার্থ রয়েছে।সংশ্লিষ্ট পাথর কোয়ারীগুলো থেকে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে

পাথর উত্তোলনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছেন সচেতন মহল।

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.