মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন প্রায় পাঁচ শতাব্দীর ঐতিহাসিক খেরুয়া মসজিদ

0

সেলিম রেজা,স্টাফ রিপোর্টার বগুড়া ঃ

মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রায় পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহাসিক খেরুয়া মসজিদ। বগুড়ার শেরপুর উপজেলা সদর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে গ্রামীন সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশে খন্দকারটোলা গ্রামে এ মসজিদটির অবস্থান। যে মসজিদটির নির্মাণ শৈলী আজও দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটক ও দশনার্থীদের হৃদয় মনে ভীষণভাবে সাড়া দেয়। সীমানা প্রাচীর ঘেরা এ মসজিদটির ভেতরে প্রবেশদ্বারের সামনেই রয়েছে প্রতিষ্ঠাতার কবর। খেরুয়া মসজিদ বাংলায় বিদ্যমান মুগল মসজিদ সমূহের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের মসজিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি সুলতানী যুগের শেষে, বাংলায় মুগল শাসনের সূচনালগ্নে বারো ভূঁইয়া এবং বাংলায় অবস্থানরত আফগান প্রধানদের মুগল বিরোধী বিদ্রোহ চলাকালে নির্মিত। মসজিদের সংস্থাপিত শিলালিপির ভাষ্যে জানা যায় যে, মসজিদটি ৯৮৯ হিজরি/১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে জওহর আলী খান কাকশালের পুত্র নবাব মির্জা মুরাদ খান নির্মাণ করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, ১৬ শতকে বাংলায় অবস্থিত কাকশালরাও মুগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং বর্তমান বগুড়া জেলার শেরপুর মোর্চায় (আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে এ অঞ্চলকে শেরপুর মোর্চা বলে উল্লেখ করেছেন) কাকশালদের শক্ত ঘাঁটি ছিল।

শেরপুর শহরটি করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে এবং বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। খেরুয়া মসজিদের অবস্থান শেরপুর শহর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে। মসজিদে সংস্থাপিত লিপির সাক্ষ্যে ধারনা করা হয় যে, ১৬ শতকের শেষার্ধে উক্ত অঞ্চলে কাকশালদের দ্বারা একটি মুসলিম সমাজ গড়ে উঠেছিল এবং পরবর্তীতে তা কাকশাল বিদ্রোহীদের কেন্দ্রে পরিণত হয়। আয়তাকার মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ্যে ১৭.৩৪ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্থে ৭.৫ মিটার। মসজিদের ভেতরের মাপ দৈর্ঘ্যে ১৩.৭২ মিটার এবং প্রস্থে ৩.৮ মিটার। চারদিকের দেয়াল প্রায় ১.৮৩ মিটার পুরু। মসজিদের চারকোণে রয়েছে চারটি অষ্টভূজ মিনার। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে প্রবেশ এর জন্য তিনটি দরজা এবং মাঝের দরজাটি অপর দু’টি থেকে অপেক্ষাকৃত বড় আকারের। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালেও রয়েছে একটি করে দরজা। ভিতরের পশ্চিম দেয়াালে আছে আয়তাকার কাঠামোর মধ্যে তিনটি অর্ধগোলাকার অবতল মিহরাব। মাঝের মিহরাবটি অপর দু’টি থেকে আকারে বড়। একটি একক আইলের ওপর তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ এটি। গম্বুজ তিনটি উপুর করা নকশা বিহীন তিনটি সমান বাটির মত। সুলতানী আমলের গম্বুজের নির্মাণ শৈলীর সঙ্গে এই খেরুয়া মসজিদের গম্বুজের স্টাইলের মিল রয়েছে। ছাদের কার্ণিশে বাংলার স্থানীয় কুঁড়ে ঘরের স্থাপত্যের ছাপ সুস্পষ্ট এবং যে কারণেই কার্ণিশের দু’ধার সামান্য বাঁকানো। বাংলার কুঁড়ে ঘরের আদলে নির্মিত এমন ছাদ ১৫ শতকে নির্মিত বাংলার অধিকাংশ স্থাপত্যে লক্ষ্য করা যায়। মসজিদের সামনের দেয়াল প্যানেলিং-এর কাজ করা। এ ধরণের কাজ ঢাকায় অবস্থিত সাত গম্বুজ মসজিদেও লক্ষ্য করা যায়। খেরুয়া মসজিদে কিছু পোড়ামাটির ফলকের অলংকরণও ছিল। এখন তা চোখে পড়ে না। মসজিদের মাঝের দরজার দু’ধারে দু’টি শিলালিপি ছিল। তাদের একটি বর্তমানে করাচি জাদুঘরে সংরক্ষিত। অপরটি মসজিদের দেয়ালে সংস্থাপিত রয়েছে। শিলা খন্ডটির আকার দেখে ধারণা করা হয় যে, সম্ভবত এটি কোনো মূর্তি স্থাপনের শিলাখন্ড যার উল্টো দিকে লিপি খোদাই করে মসজিদের দেয়ালে সংস্থাপিত হয়।

বাংলার ইতিহাসে ১৬ শতকের শেষাংশ বারভূঁইয়াদের কর্তৃক মুগল বিরোধী বিপ্লবের সংকটপূর্ণ সময় হিসেবে চিহ্নিত। তখন শেরপুর মোর্চা ছিল কাকশাল বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি যারা বাংলার বারোভূঁইয়া ছাড়াও আফগান বিদ্রোহীদের নেতা মাসুম খান কাবুলীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। বিদ্রোহী সকল দলের কাছে শেরপুর মোর্চা একটি আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত ছিল। ফলে তাঁরা সেখানে একটি অস্থায়ী মুসলিম সমাজ গড়ে তুলেছিলেন এবং খেরুয়া মসজিদটি নতুন গড়ে ওঠে মুসলিম সমাজের প্রয়োজনেই নির্মিত হয়েছিল। রাজনৈতিকভাবে সংকটকালে নির্মিত বলেই মসজিদের নির্মাণশৈলী এবং অলংকরণে অযতেœর ছাপ সুস্পষ্ট। তবে বাংলায় মুগল পবের্র সূচনা কালের মসজিদ হিসেবে খেরুয়া মসজিদ-এর পৃথক গুরুত্ব রয়েছে। কারণ মসজিদটি তৎকালীন বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এ মসজিদটি দীর্ঘ সময় অবহেলায় পড়ে থাকে। তবে ৯০’র দশকে দেশের প্রতœতত্ত বিভাগ মসজিদটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ও আগের অবস্থায় ফিরে আনে। পরে ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতœতত্ত বিভাগ মসজিদটিসহ এর সম্পত্তি দেখভালের জন্য একজন খাদেম নিয়োগ দেয়। ইতিহাস সমৃদ্ধ এ মসজিদটি পরিদর্শনে প্রতিনিয়ত দেশ বিদেশের বহু পর্যটক ও দর্শনার্থীসহ স্থাপত্য বিশারদরা আসেন। তবে মাত্র কয়েকশ’ গজ কাঁচা সড়ক ঐতিহাসিক এ মসজিদটিকে কিছুটা দুর্গম করে রেখেছে। এ অবস্থায় মসজিদটিতে দেশ বিদেশের পর্যটকদের সরাসরি আসার জন্য পাকা সড়ক নির্মাণ করা প্রয়োজন। এতে মসজিদ পরিদর্শনে আসা ভ্রমণ পিয়াসী মানুষের যেমন তৃষ্ণা মেটাবে তেমনি মুসলিম স্থাপত্য সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের মাঝে আগ্রহ যোগাবে।

Leave A Reply